বৃহস্পতিবার ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম >>
শিরোনাম >>
পুলিশের বিশেষ শাখার প্রতিবেদন

লিয়াজোঁ অফিসের আড়ালে বায়িং হাউজ ব্যবসা

  |   সোমবার, ২৪ জুলাই ২০২৩   |   প্রিন্ট   |   208 বার পঠিত

লিয়াজোঁ অফিসের আড়ালে বায়িং হাউজ ব্যবসা

ফাইল ছবি

লিয়াজোঁ অফিস স্থাপনের শর্ত ভঙ্গ করে ১৭ বিদেশি প্রতিষ্ঠান মোটা অঙ্কের আয়কর ফাঁকি দিয়েছে। এর সবই তৈরি পোশাক খাত সংশ্লিষ্ট বায়িং হাউজ। এসব প্রতিষ্ঠানের কাজ ছিল দেশিয় বিভিন্ন গার্মেন্টের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের পর সেগুলো আদান-প্রদান করা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষেত্রবিশেষে পরামর্শক হিসাবে কাজ করছে এবং তার বিপরীতে ফি আদায় করছে। সম্প্রতি পুলিশের বিশেষ শাখার তদন্তে এ তথ্য উঠে এসেছে।

এ অবস্থায় লিয়াজোঁ অফিসগুলোর নিবন্ধন বাতিলপূর্বক ব্রাঞ্চ অফিস হিসাবে গণ্য করে রাজস্ব আদায়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চিঠি দেওয়া হয়েছে। পুরোনো আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী লিয়াজোঁ অফিসের কর হার শূন্য ছিল। অর্থাৎ বাংলাদেশে এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে কর দিতে হতো না। আর ব্রাঞ্চ অফিসের কর হার ৩৫ শতাংশ। অর্থাৎ ব্রাঞ্চ অফিসকে করপোরেট হারে আয়কর দিতে হবে। যদিও নতুন আয়কর আইনে লিয়াজোঁ অফিসকে কোম্পানি হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। তাই ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে কোম্পানি হারে কর দিতে হবে। ২০২১ সালে ট্যাক্স জাস্টিস নেটওয়ার্কের ‘দ্য স্টেট অব ট্যাক্স জাস্টিস-২০২১’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বহুজাতিক কোম্পানি ও অতি সম্পদশালী ব্যক্তিদের কর ফাঁকির কারণে বাংলাদেশ বছরে প্রায় সাড়ে ১৪ কোটি ডলারের সমপরিমাণ কর হারাচ্ছে, টাকার অঙ্কে যা প্রায় এক হাজার ২৩৭ কোটি টাকা। কর রাজস্ব হারানোয় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। ভারত ও পাকিস্তান প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।

পুলিশের বিশেষ শাখার প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) গাইডলাইন অনুযায়ী সীমিত জনবল দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করার নির্দেশনা থাকলেও প্রতিষ্ঠানগুলো বিধিবহির্ভূতভাবে বিভিন্ন পদে জনবল নিয়োগ দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এসব প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কনসালট্যান্সি বা পরামর্শক হিসাবে সার্ভিস দিয়ে চার্জ বা ফি আদায় করছে। প্রকৃতপক্ষে ব্রাঞ্চ অফিসের মতো কমার্শিয়াল কার্যক্রম পরিচালনা করছে তারা। এগুলো কর ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে-ফ্রান্সের কেজিএস সোর্সিং লিমিটেড, দুবাইয়ের ক্লিইডার সোর্সিং এফজেডসিও, দক্ষিণ আফ্রিকার এল কোর্তে ইঙ্গলিস এসএ, হংকংয়ের পোয়েটিকজেম ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, ডিজাইন আর্ক এশিয়া লিমিটেড, ক্র্যাইওন্স সোর্সিং লিমিটেড, টেক্স-এবো ইন্টারন্যাশনাল পিটিই-লি., ক্লেভার কালেকশন লিমিটেড, বিউম্যানিওর এশিয়া সোর্সিং পিইটি লিমিটেড, প্লাস ট্রেডিং ফার ইস্ট লিমিটেড, নরওয়েস্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, পিভিএইচ ফার ইস্ট লিমিটেড, জামিরা ফ্যাশন লিমিটেড, অট্টো ইন্টারন্যাশনাল (এইচকে) লিমিটেড, ফুললি সান চায়না, সিম্পল অ্যাপ্রোচ লিমিটেড এবং জাপানের ইউনিক্লো কোম্পানি লিমিটেড।

এ বিষয়ে টেক্স-বো’র কান্ট্রি ডিরেক্টর সৈয়দ খালিদ হোসেন বলেন, ‘এটি বায়িং হাউজ। বিডায় বিদেশি কোম্পানির লিয়াজোঁ অফিস হিসাবে নিবন্ধিত। এ অফিস বিদেশ থেকে অর্ডার এনে স্থানীয় কারখানায় পণ্য উৎপাদন করে তা রপ্তানি করে।’ আপনার প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে আয়সংশ্লিষ্ট কাজে যুক্ত কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসাবে আমি শুধু প্রডাকশন, মার্কেটিং এবং শিপমেন্টের বিষয়গুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত। ফিন্যান্স-অ্যাকাউন্ট সিঙ্গাপুরে মূল অফিস দেখভাল করে। তবে আমি যতদূর জানি, আমাদের প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় কোনো ধরনের আয় নেই।’ আর কেজিএস সোর্সিংয়ের এইচআর ম্যানেজার শামীম উল আহসান যুগান্তরকে জানান, ‘অর্ডার আনা থেকে পণ্যের শিপমেন্ট পর্যন্ত তদারক করে থাকে কেজিএস সোর্সিং। এ কাজে কমিশন বা অর্থ আদান-প্রদান হয় মূল প্রতিষ্ঠানে। তিনি বলেন, পরামর্শক ফি বা সার্ভিস চার্জ আদায়ের যে অভিযোগ করা হচ্ছে, তা সঠিক নয়। এর বেশি বলতে কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগবে।’ এর আগে আরেকবার তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কেউ মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছে না।’

জানা যায়, বাংলাদেশে বিদেশি পোশাকসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের লিয়াজোঁ বা ব্রাঞ্চ অফিস স্থাপনের অনুমতি দেয় বিডা। এজন্য বিডার একটি গাইডলাইন আছে, যেখানে লিয়াজোঁ ও ব্রাঞ্চ অফিসের কর্মপরিধি উল্লেখ করা হয়েছে। লিয়াজোঁ অফিস স্থাপন সম্পর্কে বলা হয়েছে, লিয়াজোঁ বিডার অনুমতির বাইরে অন্য কার্যক্রমে নিয়োজিত হতে পারবে না। পাশাপাশি স্থানীয় উৎস থেকে আয় করতে পারবে না। অফিস স্থাপন, পরিচালন ব্যয়, স্থানীয়/বিদেশি জনবলের বেতন-ভাতা ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে আনতে পারবে। বৈদেশিক মুদ্রা অব্যয়িত অর্থের বাইরে অন্য কোনো অর্থ বিদেশে পাঠাতে পারবে না। লিয়াজোঁ অফিসের কাজ হবে- পত্র যোগাযোগ, ব্যক্তিগত ও ইলেকট্রনিক যোগাযোগমাধ্যমে বিদেশের প্রধান কার্যালয় ও বাংলাদেশের স্থানীয় এজেন্ট, সরবরাহকারী/রপ্তানিকারক/আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ব্যবসায়িক সমন্বয় করা।

অন্যদিকে ব্রাঞ্চ অফিস বা শাখা অফিস সম্পর্কে বলা হয়েছে, ব্রাঞ্চ অফিস মূল কোম্পানির পক্ষে বাংলাদেশে ক্রয়-বিক্রয় প্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে। এছাড়া মূল কোম্পানি বা বিদেশি কোনো কোম্পানি এবং বাংলাদেশি কোম্পানির মধ্যে কারিগরি বা আর্থিক সহযোগিতা দিতে পারবে। পেশাদারি বা পরামর্শক সেবা বা ঠিকাদার বা উপ-ঠিকাদার হিসাবে কাজ করতে পারবে। যথাযথ অনুমোদনসাপেক্ষে আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায় সম্পৃক্ত হতে পারবে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ৩০ মে পর্যন্ত এক হাজার ৬৬টি বিদেশি কোম্পানির লিয়াজোঁ অফিস যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তরে (আরজেএসসি) নিবন্ধিত আছে। এর মধ্যে ৭৯২টি বিদেশি কোম্পানির লিয়াজোঁ অফিস এবং ৩৬৫টি ব্রাঞ্চ অফিস এনবিআরের আওতায় নিবন্ধিত আছে। অর্থাৎ ২৭৪টি লিয়াজোঁ অফিস এনবিআরের তালিকায় নেই, এরা রিটার্নও জমা দেয় না।

সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন : এ বিষয়ে বিডার মহাপরিচালক শাহ মোহাম্মদ মাহবুব বলেন, লিয়াজোঁ অফিসগুলো শর্তভঙ্গ করে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শক সেবা দিয়ে বা অন্য কোনোভাবে আয় করছে-এ ধরনের অভিযোগ পেলে তদন্তসাপেক্ষে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘লিয়াজোঁ অফিস স্থাপন করে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো কর ফাঁকি দিচ্ছে কিনা, সেটা বড় কথা নয়। বড় বিষয় হচ্ছে, এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে যথাযথ মনিটরিং করতে এনবিআর ব্যর্থ। এ বিষয়ে এনবিআরের নিজস্ব কোন ডাটাবেজ নেই, পরিসংখ্যানও নেই।’

দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এ ধরনের প্রতারণামূলক প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করায় পুলিশের বিশেষ সংস্থাকে সাধুবাদ জানাই। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে কর বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার একযোগে কাজ করা উচিত। এ ধরনের আরও প্রতিষ্ঠান থাকলে সেগুলোকেও চিহ্নিত করার মাধ্যমে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।’

 

Facebook Comments Box

Posted ১:২০ অপরাহ্ণ | সোমবার, ২৪ জুলাই ২০২৩

bangladoinik.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

https://prothomalo.com
https://prothomalo.com

এ বিভাগের আরও খবর

https://prothomalo.com
https://prothomalo.com
সম্পাদক ও প্রকাশক
ফখরুল ইসলাম
সহসম্পাদক
মো: মাজহারুল ইসলাম
Address

2nd floor, Opposite building of Muradnagar Thana gate, Muradnagar-3540, Bangladesh

01941702035, 01917142520

bangladoinik@gmail.com

জে এস ফুজিয়ামা ইন্টারন্যাশনালের একটি প্রতিষ্ঠান। ভ্রাতৃপ্রতিম নিউজ - newss24.com