| বুধবার, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | প্রিন্ট | 404 বার পঠিত
‘গ্রন্থমেলা’ নিয়ে লেখতে গিয়ে ‘বাংলা ভাষা’ সম্পর্কে দু’একটি কথা না বললে আমাদের এই গৌরবের বাংলা ভাষার প্রতি অবিচারই করা হবে। ‘ভাষা’, ‘ভাষা আন্দোলন’ এবং ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ এই তিনটি বিষয় আমাদের জীবনের সাথে মিশে আছে গভীরভাবে। বিশ্বের দরবারে বাংলা ভাষা নিয়ে যে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে আর কোন দেশের ভাষা নিয়ে এমন ইতিহাস নেই বললেই চলে। আর তারই স্বাক্ষর হিসেবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার দীর্ঘ ত্রিশ বছর পর আজ ভাষার সেই আন্দোলনের সোনালি ফসল হিসেবে ২১ ফেব্রæয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের’ মর্যাদা লাভ করেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের বেশ ক’টি ধাপের মধ্যে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। পাকিস্তানের ৫৬% লোকের ভাষা বাংলা হওয়ায় পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই পূর্ববাংলার বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিস বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানায়। কিন্তু এই দাবি নানাভাবে উপেক্ষিত হয়। আজো মনে পরে বাঙালি জাতির উপর অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়া সেই শ্লোগানের কথা। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এবং ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন, ÔÔUrdo and udro shall be the state language of Pakistan’’। এর তীব্র পতিবাদ এবং অতপর ১৯৫৬ সালে উর্দুর সাথে বাংলাও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। গ্রন্থমেলা। সাধারনভাবে ‘মেলা’ শব্দের অর্থ সম্মিলন, যেখানে কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে বহু মানুষের সমাগম ঘটে, আনন্দ-উৎসব এবং প্রদর্শনী ও বেচাকেনা হয়। ‘গ্রন্থমেলা’র ইতিহাস প্রাচীন। ১৯৪৯ সালে ফ্রাঙ্কফুর্টে অনুষ্ঠিত গ্রন্থমেলা হচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম গ্রন্থমেলা। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে মুক্তধারা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান নিজেদের উদ্যোগে প্রথম গ্রন্থমেলা চালু করে। একুশে গ্রন্থমেলা সরকারি উদ্যোগে সম্পন্ন হয় এবং মেলার দায়িত্ব পরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র বাংলা একাডেমির উপর। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে গ্রন্থমেলা সূচনা হয়। ‘উৎসব’ আনন্দের অন্যতম মাধ্যম। তা হতে পারে ধর্মীয়, সামাজিক এবং রাজনৈতিক। ‘বাঙালি উৎসব’ বাঙালিকে বলা হয় উৎসবের জাতি। একটি প্রবাদও আছে ‘বার মাসে তের পার্বণ’ ধর্মীয় উৎসব ব্যতিরিকে রয়েছে বাঙালির ভিন্ন ধাচের ভিন্ন ঢঙের বিচিত্রসব উৎসব। অনেক উৎসবেই আমরা বাঙালির উৎসব পালন করতে গিয়ে আমাদের স্বীয় জাতীয়তার সাথে মিশিয়ে ফেলি বিজাতীয় সংস্কৃতির কৃষ্টি কালচার। তা হতে পারে আধুনিকতার ছোঁয়া বা বিজ্ঞানের সম্প্রসারণের ফলে। আমরা ভুলে যাই আমাদের নিজেদের কৃষ্টি কালচারের মর্মকথা। উৎসবে বাংলা গান গাইতে গিয়ে উপস্থাপন করি প্রাশ্চাত্য স্টাইলে, নৃত্য দিতে গিয়ে নুপূরের ধ্বনির পরিবর্তে দেখিয়ে থাকি শরীরের খসরত। বাঙালির অন্যসব উৎসবে বাঙালির কৃষ্টি কালচারের সাথে কোন সংস্কৃতির মিশ্রিন ঘটলেও অমর একুশে গ্রন্থমেলা উৎসবটি আমাদেরকে বার বার স্মরণ করিয়ে বাঙালির শেখর থেকে শিকড়ে। স্মরণ করিয়ে দেয় আমরা বাঙালি জাতি, আমরা সংগ্রামের জাতি, অধিকার আদায়ে পদ্ধপরিকর আমরা। বই জ্ঞানের ভান্ডার। অমর একুশে গ্রন্থমেলা নবীনদেরকে আমাদের জাতির ইতিহাস সম্পর্কে জানাতে সক্ষম হয়, অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেয় এবং বর্তমান অবস্থাকে পরিমাপ করতে সাহায্য করে। বরাবরের মত এবারও অমর একুশে গ্রন্থমেলা’য় ২০১৬ কবি-সাহিত্যেকদের প্রকাশিত হয়েছে হাজারো বৈচিত্র ধরনের বই। সব আনন্দের মধ্যে বড় আনন্দ বই পড়ার আনন্দ। তবে তার রস খোঁজে বাহির করা অনেকটা কঠিন। বই পড়ার আনন্দ সম্পর্কে কবি ওমর খৈয়াম বলেছেন, “রটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্তযৌবনা যদি তেমন বই হয়।” বাঙালির অমর একুশে গ্রন্থমেলার উৎসবে বই কেনাকে আমরা যদি শখ হিসেবে গড়ে তুলি তাহলে একদিকে যেমন অমর একুশে গ্রন্থমেলাটি হবে স্বার্থক অন্যদিকে নবীন লেখক-লেখিকারা বই রচনায় হবেন আগ্রহী । আর সেই ক্ষেত্রে পাঠকের যেমন নবীনদের বই কেনা প্রয়োজন তেমনি মিডিয়ারও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। বর্তমান যুগ মিডিয়ার যুগ। মিডিয়ার উচিত হবে শুধুমাত্র নামকরা বা প্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিকদের লেখা সম্পর্কে প্রচারণার সাথে সাথে নবীনদের লেখা সম্পর্কেও প্রচার করা। ভুলে গেলে চলবে না আজকে যারা নবীন কাল তারাই প্রবীণ। আর একটি বিষয় লক্ষ্যনীয়, অমর একুশে গ্রন্থমেলায় দেখা যায় অনেক লেখক ইংরেজিতে গ্রন্থ রচনা করে থাকেন। বিশ্বায়নের যুগে ইংরেজির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করছি না। যেসব লেখক ইংরেজিতে গ্রন্থ রচনা করেন তাদের ভুলে গেলে চলবে না, ‘একুশ’ বাংলা ভাষা থেকেই সৃষ্ট ইতিহাস, আর এই জন্যই বলা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা। আর তাই লেখক যে গ্রন্থটি ইংরেজিতে লেখা প্রযোজন মনে করেন, তা বাংলায় রচনার সাথে সাথে ইংরেজিতে রচনা করা যেতে পারে। অন্যথায় অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে অবমাননাই করা হয়।
একটি ভাবনা ভেবে দেখুন, অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাঙালির সকল উৎসবকে পরিশোধন করে স্মরণ করিয়ে দেয় আমরা বাঙালি, আমরা আমাদের নিজেদের কৃষ্টি কালচারে বিশ্বাসী। বিশ্বব্যাপী আধুনিকার ছোঁয়া লাগলেও বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্য আধুনিকতা থেকে কোন অংশে পিছিয়ে নয়। ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ ফর্মালিনমুক্ত বাঙালির একটি উৎসব যে উৎসব শুধুমাত্র বাঙালি সংস্কৃতির কথা বলে, যে উৎসব বাঙালির পরিচয় বহন করে এবং স্মরণ করিয়ে দেয় আমরা বাঙালি। আর তাই ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ বাঙালির অন্যসব উৎসব পরিশোধনের গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম বললে কোন অংশে ভুল হবে না।
লেখকঃ মোঃ মাজহারুল ইসলাম, কলামিস্ট ও সমাজকর্মী
Posted ৬:৪৮ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
bangladoinik.com | Belal Hossain
জে এস ফুজিয়ামা ইন্টারন্যাশনালের একটি প্রতিষ্ঠান। ভ্রাতৃপ্রতিম নিউজ - newss24.com