বদিউজ্জামান রাজাবাবু: | মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | প্রিন্ট | 69 বার পঠিত
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক একে এম গালিব খাঁন বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বছরে অন্তত ১০ কোটি টাকা চাঁদাবাজি করে আসছেন বলে বিভিন্ন সুত্রে জানা যায়। সরকারি দিবস পালনের নামে, বালুমহাল ও জলমহল ইজারা থেকে ৫ শতাংশ কমিশন হিসেবে এবং অবৈধ ইটভাটা থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন জেলা প্রশাসক এ কে এম গালিভ খাঁন। চাঁদাবাজির বিপুল এই টাকা এলআর ফান্ডের (লোকাল রিলেশন্স) নামে ‘হালাল’ করা হয়।
স্থানীয় পর্যায়ে বেসরকারি চাঁদা বা অনুদানের অর্থে এলআর ফান্ড গঠিত। তবে চাঁদাবাজির এই নিয়ম পুরনো হলেও গত দুই বছর এর মাত্রা ছিল ভয়াবহ। এ কে এম গালিভ খাঁন ২০২২ সালের ১৩ জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ২৪তম বিসিএস কর্মকর্তা। নিজ জেলা কিশোরগঞ্জ। নিজেকে সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের নিকটাত্মীয় পরিচয় দিতেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতেন আওয়ামী লীগ নেতার মতোই। বিএনপি ও জামায়াতপন্থি জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে করতেন দুর্ব্যবহার।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার দিন ডিসির বাসভবনেও ভাঙচুর, লুটপাট করে বিক্ষুব্ধ জনতা। ওইদিন তিনি আগেই ৫৯ বিজিবি ক্যাম্পে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। জেলা প্রশাসকের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি এখন সামনে আসছে। তবে ব্যবসায়ীরা প্রশাসনের রোষানল থেকে বাঁচতে গণমাধ্যমে নাম প্রকাশ করতে চাননি। তাদের যুক্তি এই দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনের কর্মকর্তারা এখন জনপ্রতিনিধিদের চেয়ারে।
জানা গেছে, ডিউটিস অব চার্টার অনুযায়ী জেলা প্রশাসক জেলার বিভিন্ন দপ্তর সম্পর্কিত শতাধিক কমিটির সভাপতি। জেলায় অবস্থিত প্রতিটি মন্ত্রণালয় বা বিভাগের অফিস জেলা প্রশাসনের অংশ এবং জেলা প্রশাসকের সাধারণ নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন। আইনশৃঙ্খলা, অবকাঠামো উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসা, বিনোদন, শিক্ষা, বিজ্ঞান, কর্মসংস্থান, নারী ও শিশু, ধর্ম, পাঠাগার, দুর্যোগ ও ত্রাণ, কৃষি, প্রাণী, সার ও বীজ এসবের তত্ত্বাবধানও জেলা প্রশাসনের আওতায়। তবে গত আড়াই বছরে এ কে এম গালিভ খাঁনের ইতিবাচক কোনো কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হয়নি। এ জেলায় যোগদানের পর থেকে তিনি দুর্নীতি আর অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। এতে সহযোগিতা করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আহমেদ মাহবুব-উল ইসলাম ও নেজারত শাখার নাজির স্বাধীন চন্দ্র। বিলাসিতার জন্য ডিসি তার বাংলোতে স্ত্রী সন্তানের নামে করেছেন কর্নার, বানানো হয়েছে অপ্রয়োজনীয় শেড, নাম দিয়েছেন ‘আনন্দধারা’।
এছাড়াও বরাদ্দের ত্রাণ নয়ছয়, শিশুপার্ক সংস্কার ও মেলা আয়োজন করে বিপুল অংকের টাকা হাতিয়েছেন ডিসি। কালেক্টরেট শিশু পার্কের পাশে ৯টি দোকানঘর নির্মাণ করা হয়েছে। আরও ৪টির নির্মাণকাজ চলছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে কোনো টেন্ডার ছাড়াই। বিভিন্ন ইটভাটা থেকে চাঁদা হিসেবে নেওয়া হচ্ছে ইট। সরকারি অর্থ হাতিয়ে নিতেই এসব আয়োজন। মানা হচ্ছে না কোনো নিয়মনীতি। নাচোলে ইলামিত্র সংগ্রহশালা নির্মাণেও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধান বলছে- চাঁপাইনবাবগঞ্জে অর্ধশতাধিক অটোরাইস মিল রয়েছে। রয়েছে একাধিক চালকল মালিক সমিতি। তারা প্রতিটি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষে জেলা প্রশাসকের (ডিসি) ‘আমন্ত্রণ’ রক্ষায় লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দেন। অনুসন্ধানকালে অনেক ব্যবসায়ী ও সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ হয়। সবাই এক বাক্যে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান ঘিরে চাঁদাবাজির কথা স্বীকার করলেও কেউ নাম প্রকাশ করে তথ্য দিতে রাজি হননি। কেউ কেউ বলেছেন- প্রশাসনকে এই চাঁদা বা ‘অনুদান’ না দিলে নির্বিঘ্নে ব্যবসা চালানো কঠিন।
বিশেষ দিবস ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের নামে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের বেপরোয়া এই চাঁদাবাজি অনেকটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। গোপন আলাপে পাওয়া তথ্যের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে বেপরোয়া চাঁদাবাজির প্রমাণ মিলেছে।
অভিযোগ আছে, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আপ্যায়নে এই তহবিল থেকে যতটা ব্যয় হয়, তার অনেক গুণ বেশি ডিসি ব্যক্তিগত কাজে খরচ দেখিয়ে লোপাট করেন। এ নিয়ে জেলা প্রশাসনের ভেতরেই ক্ষোভ রয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে টাকার চাপ দেওয়া হয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদেরও। সদ্য বিলুপ্ত হওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্মানি পাওয়া ৫০ লাখ টাকা অধস্তন কর্মকর্তাদের নিয়ম অনুযায়ী না দিয়ে ৩০ লাখ ডিসি নিজেই নিয়েছেন এমন অভিযোগও রয়েছে।
জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জে অবৈধ ইটভাটার সংখ্যা প্রায় দুই শতাধিক। উচ্চ আদালত থেকে এসব অবৈধ ইটভাটা বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয় জেলা প্রশাসনকে। তবে নিকট অতীতে কোনো অবৈধ ইটভাটা বন্ধের খবর জানা যায়নি। কিভাবে অবৈধ এত ইটভাটা চলছে, সেই উত্তর খুঁজতে পাওয়া যায় জেলা প্রশাসনের কোটি টাকার চাঁদাবাজির তথ্য। প্রতিটি ইটভাটা থেকে ১ থেকে দেড় লাখ টাকা চাঁদা নেয় জেলা প্রশাসন। ইটভাটা মালিক সমিতি প্রতিটি ইটভাটা থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে পৌঁছে দেয় ডিসির কাছে। শুধু ইটভাটা থেকেই জেলা প্রশাসন চাঁদাবাজি করে প্রায় আড়াই কোটি টাকা।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়েন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর সব জেলা প্রশাসককে প্রত্যাহারের ঘোষণা আসে। এরপর থেকে ডিসি নিজেই চাঁদাবাজি শুরু করেছেন। দামুস বিল, মরিচা বিল ও রাণীনগর বালু মহলের ইজারাদারকে ডেকে চাঁদা দাবি করছেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে জেলা প্রশাসক একেএম গালিভ খাঁন তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, কালেক্টরেট শিশু পার্কের পাশে যে মার্কেট নির্মাণ করা হচ্ছে- সেটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষের জন্য।
জলমহাল এবং বালুমহালের ইজারাদারের কাছ থেকে ৫ শতাংশ হারে কমিশন ও অবৈধ ইটভাটা থেকে এলআর ফান্ডের নামে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
Posted ১২:৫৫ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪
bangladoinik.com | Belal Hossain
জে এস ফুজিয়ামা ইন্টারন্যাশনালের একটি প্রতিষ্ঠান। ভ্রাতৃপ্রতিম নিউজ - newss24.com